মানুষের প্রধান গুণ মানবিকতা। নৈতিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সৃষ্টি হয় মানবিকতা। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সমাজে বসবাসের জন্য কিছু নিয়ম-নীতি পালন করতে হয়। এজন্য মানুষ সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকে। একে অন্যকে সহযোগিতা করে। মানুষ ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় বিচার করে সততার সাথে কাজ করে। কয়েকটি নৈতিক ও মানবিক গুণ হলো স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সততা, সত্যবাদিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, উদারতা, পরোপকার ইত্যাদি।
সৎ পথে চলা। কথার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করা।
এসব হলো সততা। সত্যবাদিতা হলো সত্য কথা বলা।
একে অন্যকে শ্রদ্ধা করা হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।
অন্যের কষ্ট নিজের বলে মনে করা। সে অনুযায়ী তাকে সহায়তা করা হলো সহমর্মিতা।
শুধু নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাবা হলো উদারতা।
পরের উপকার করাই হলো পরোপকার।
আমরা প্রতিদিন নানান কাজ করে থাকি। এর মধ্যে আছে কিছু ভালো কাজ। কিছু মন্দ কাজ। যে কাজগুলো সবার জন্য মঙ্গলজনক, তা ভালো কাজ। আর যে কাজ সবার জন্য ক্ষতিকর, তা মন্দ কাজ। তাই কোনো কাজ করার আগে ভাবা উচিত, সেটা ভালো না মন্দ কাজ।
পরোপকারী মানুষ সবসময় অন্যের কথাই ভাবেন। নিজের জন্য ভাবেন না। পরোপকারী নিজের কাজের বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশা করেন না। এরূপ যাঁরা তাঁরা মহৎ। আমাদের সমাজে অনেক পরোপকারী আছেন। আমাদের ধর্মগ্রন্থে অনেক পরোপকারের কাহিনি পাওয়া যায়। এ রকম একটি কাহিনি এসো পড়ি।
মহাভারতের কাহিনিতে পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব ছিলেন ভীম। ভীম প্রবল শক্তির অধিকারী ছিলেন। রাজ্য নিয়ে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে ছিল ভীষণ শত্রুতা। কৌরবেরা একশত ভাই ছিল। তারা সবসময় পাণ্ডবদের হিংসা করত। কৌরবরা একবার পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারা কৌশলে একটা জতুগৃহ তৈরি করেছিল। মা কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডব এই জতুগৃহে ছিল। গৃহে আগুন দেয়া হলো। কিন্তু তারা বেঁচে গেল। আগুন লাগার আগেই তারা পালিয়ে বাঁচল। এক ব্রাহ্মণের গৃহে তারা আশ্রয় নিল। সেখানে ব্রাহ্মণের বেশে তারা বাস করতে লাগল। একদিন ঐ গৃহে কান্নাকাটির শব্দ শোনা গেল। সেদিন ভীম মায়ের কাছে ছিলেন। অন্য চার ছেলে তখন ঘরের বাইরে। মা কুস্তী কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে পারলেন।
সে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। নগরীর নাম একচক্রা। এই নগরীর একদিকে একটি বন আছে। বক নামে এক রাক্ষস সেই বনে বাস করে। প্রত্যেকদিন তাকে খেতে দিতে হয়। এই খাবার হলো একজন মানুষ, দুটি মহিষ এবং প্রচুর ভাত। সেইসঙ্গে দই মিষ্টি তো আছেই। এর অন্যথা হলে সে সবাইকে মেরে ফেলবে। এক এক দিন এক এক পরিবার থেকে তার জন্য খাবার পাঠানো হয়। সেই হিসেবে আজ ব্রাহ্মণ পরিবারের পালা। এই পরিবার থেকে যে-কোনো একজনকে যেতে হবে। এখন কে যাবে! তাই নিয়ে কান্নাকাটি। কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না।
সব কথা শুনে কুস্তী তাদের বললেন, কাউকে যেতে হবে না। কোনো চিন্তা করবেন না। আমার পাঁচ ছেলে আছে। এদের একজন যাবে আপনাদের পক্ষ হয়ে।
তখন গৃহস্বামী বললেন, এটা কেমন করে হয়? শরণার্থী হিসেবে আপনারা আমাদের কাছে আছেন। আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের কোনো বিপদে ফেলতে পারব না। কুস্তী ব্রাহ্মণকে অভয় দিলেন।
মা কুস্তী ভীমকে সব কথা বললেন। ভীম শুনে খুব খুশি। ভীম একে তো মহাবীর ও যোদ্ধা। তার ওপর খেতে ভালোবাসেন। তিনি একটি পরিবারকে বাঁচাতেও পারবেন। পরদিন ভীম বক রাক্ষসের এলাকায় গেলেন। বক তখন কাছে ছিল না। ভীম বসে মনের আনন্দে খাবার খেতে লাগলেন। রাক্ষস ফিরে এসে তো অবাক! তার খাবার একজন মানুষ খাচ্ছে। লোকটার সাহস তো কম নয়। সে একটা গাছের কাণ্ড দিয়ে ভীমকে পেটাতে লাগল। ভীম কিছুই বললেন না। মনে মনে হাসতে লাগলেন। পিঠে একটু সুড়সুড়ি লাগছিল, এই যা। একসময় খাওয়া শেষ হলো। দই খেয়ে হাত মুখ ধুলেন। তারপর ভীম বক রাক্ষসকে আক্রমণ করলেন এবং মেরে ফেললেন।
কুন্তী পরোপকারী। ভীমও পরোপকারী। পরোপকারী ভীমের জন্য একটি নগর রক্ষা পেল। একটি পরোপকারের কথা বলো যেটা তুমি করতে চাও।
শূন্যস্থান পূরণ করো:
ক) মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব ছিলেন _______ ।
খ) কৌরবেরা ______ ভাই ছিল।
গ) পরোপকারী ভীমের জন্য একটি _____ রক্ষা পেল।
যা যথার্থ, যা সঠিক তাই ন্যায়। যা ঠিক নয় তাই অন্যায়। 'ন্যায়' মূল্যবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ন্যায় হলো ভালো কাজ করা। অন্যায় না করা। সুস্থ সমাজ গঠনে প্রয়োজন ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। অন্যায় প্রতিরোধ করা। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নৈতিক শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। এ থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধও অর্জিত হয়। ফলে আমরা ভালো-মন্দ বিচার করতে পারব। সত্য-মিথ্যা, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য করতে পারব। কল্যাণ-অকল্যাণ, পাপ-পুণ্য বুঝতে পারব। দোষ-গুণের পার্থক্য করতে পারব। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হলেই উন্নত জাতি গঠিত হবে। তাই নৈতিক মূল্যবোধ খুব প্রয়োজন। সমাজ- জীবনে মূল্যবোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূল্যবোধের অভাবে সমাজে সৃষ্টি হয় নৈতিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা। এর ফলে মানুষ অন্যায়ের দিকে যায়। সমাজের মঙ্গলের জন্য মূল্যবোধ চর্চা করতে হবে। মানুষের মধ্যে ন্যায়বোধ জাগ্রত করতে হবে। এতে জীবনে পরিপূর্ণতা ও সার্থকতা আসবে।
বলতো ছবিটি কীসের?
এটা মহাভারতের যুদ্ধের ছবি। এসো মহাভারতের যুদ্ধের একটি গল্প পড়ি।
অনেকদিন আগে হস্তিনাপুর নামে এক রাজ্য ছিল। ঐ রাজ্যের রাজা ছিলেন শান্তনু। শান্তনুর তিন পুত্র। দেবব্রত, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। দেবব্রত বিয়ে করেননি। চিত্রাঙ্গদ অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান। বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র বড় কিন্তু জন্মান্ধ ছিলেন। তাই পাণ্ডু রাজা হন। ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্র ও একজন কন্যা ছিল। এদের কৌরব বলা হতো। পাণ্ডুর ছিল পাঁচ পুত্র। এদের পাণ্ডব বলা হতো। কৌরবরা লোভী ও স্বার্থপর ছিল। অপরদিকে পাণ্ডবরা ন্যায়পরায়ণ ছিল।
কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে রাজ্যের অধিকার নিয়ে বিবাদ হয়। কৌরবরা সম্পূর্ণ রাজ্য নিতে চায়। তখন তাদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের নাম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। আঠারো দিন যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাণ্ডবরা জয়লাভ করে। তারা রাজ্য ফিরে পায়। কৌরবরা পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমাদের অনেক বন্ধু চোখে দেখতে পায় না। অনেকে কানে শুনতে পায় না। অনেকে কথা বলতে পারে না। অনেকে হাঁটতে পারে না। এদের প্রত্যেকের জন্য বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। তাই এদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বলা হয়।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সাহায্য করতে হবে। সহযোগিতা পেলে এরা স্বাভাবিক মানুষের মতোই পড়ালেখা করতে পারবে। অন্যান্য কাজও করতে পারবে। মনে রাখতে হবে যে, তারা আলাদা নয়। সকল ধরনের শিশুর বিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার রয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরাও একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবে। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারাও অংশগ্রহণ করবে। সকলের সাথে সকল কাজে তারা অংশগ্রহণ করবে। অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা আনন্দ পাবে। তাদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য সকলকেই সচেতন থাকতে হবে।
একদিন শিক্ষার্থীরা দেখল, শ্রেণিকক্ষের বাইরে একজন নতুন শিক্ষার্থী বসে আছে। সে কোন দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে আপন মনে হাসছে। শিক্ষিকা এলে সবাই বলে উঠল, আমাদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে একটি পাগল বসে আছে।
শিক্ষিকা বললেন, না জেনে কাউকে পাগল বলো না। ওর নাম শুভ। শুভর বুদ্ধি স্বাভাবিকভাবে বাড়েনি। তাই তার আচরণ অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন। শুভ এ স্কুলেই ভর্তি হতে এসেছে। কিছুক্ষণ পর প্রধান শিক্ষক শুভ ও তার মাকে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে এলেন।
তিনি বললেন, ও তোমাদের নতুন বন্ধু। ওর একটু অসুবিধা আছে। একটু দেরিতে বোঝে। তবে ডাক্তার বলেছেন, শুভ স্বাভাবিক পরিবেশে থাকলে এবং ওর সাথে ভালোভাবে কথা বললে ওর সমস্যা কমে যাবে। তাই তোমরা সহযোগিতা করলে শুভ সহজে পড়াশোনা করতে পারবে। তোমরা শুভকে সহযোগিতা করবে তো?
সবাই বলল, করব স্যার।
তারা শুভকে হাত ধরে নিয়ে পাশে বসতে দিল। টিফিনের সময়ে ওকে খেলতে নিয়ে গেল। এভাবে সবাই শুভকে সহযোগিতা করল। শুভ বন্ধুদের সাহায্যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগল।
শুভ ভালো ছবি আঁকতে পারত। অল্পদিনের মধ্যে ছবি আঁকার জন্য শুভ সবার প্রিয় হয়ে উঠল। কিছুদিন আগে সে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছে। তার জন্য পুরো দেশ ঐ প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নাম জেনেছে।
আরও দেখুন...